পঞ্চম অধ্যায়

নবম-দশম শ্রেণি (দাখিল) - বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি - NCTB BOOK
Please, contribute to add content into পঞ্চম অধ্যায়.
Content

প্রথম পরিচ্ছেদ : বাক্য প্রকরণ

যে সুবিন্যস্ত পদসমষ্টি দ্বারা কোনো বিষয়ে বক্তার মনোভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয়, তাকে বাক্য বলে। কতগুলো পদের সমষ্টিতে বাক্য গঠিত হলেও যে কোনো পদসমষ্টিই বাক্য নয়। বাক্যের বিভিন্ন পদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বা অন্বয় থাকা আবশ্যক। এ ছাড়াও বাক্যের অন্তর্গত বিভিন্ন পদ দ্বারা মিলিতভাবে একটি অখণ্ড ভাব পূর্ণ রূপে প্রকাশিত হওয়া প্রয়োজন, তবেই তা বাক্য হবে।
ভাষার বিচারে বাক্যের নিম্নলিখিত তিনটি গুণ থাকা চাই। যেমন –
(১) আকাঙ্ক্ষা
(২) আসত্তি এবং
(৩) যোগ্যতা
১. আকাঙ্ক্ষা : বাক্যের অর্থ পরিষ্কারভাবে বোঝার জন্য এক পদের পর অন্য পদ শোনার যে ইচ্ছা তা-ই আকাঙ্ক্ষা। যেমন – ‘চন্দ্র পৃথিবীর চারদিকে’– এটুকু বললে বাক্যটি সম্পূর্ণ মনোভাব প্রকাশ করে না, আরও কিছু ইচ্ছা থাকে। বাক্যটি এভাবে পূর্ণাঙ্গ করা যায় : চন্দ্র পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। এখানে আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তি হয়েছে বলে এটি পূর্ণাঙ্গ বাক্য ৷
২. আসত্তি : মনোভাব প্রকাশের জন্য বাক্যে শব্দগুলো এমনভাবে পর পর সাজাতে হবে যাতে মনোভাব প্রকাশ বাধাগ্রস্ত না হয়। বাক্যের অর্থসঙ্গতি রক্ষার জন্য সুশৃঙ্খল পদবিন্যাসই আসত্তি। যেমন –
কাল বিতরণী হবে উৎসব স্কুলে আমাদের পুরস্কার অনুষ্ঠিত। লেখা হওয়াতে পদ সন্নিবেশ ঠিকভাবে না হওয়ায় শব্দগুলোর অন্তর্নিহিত ভাবটি যথাযথ প্রকাশিত হয়নি। তাই এটি একটি বাক্য হয়নি। মনোভাব পূর্ণ ভাবে প্রকাশ করার জন্য পদগুলোকে নিম্নলিখিতভাবে যথাস্থানে সন্নিবিষ্ট করতে হবে। যেমন –
কাল আমাদের স্কুলে পুরস্কার বিতরণী উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। বাক্যটি আসত্তিসম্পন্ন।
৩. যোগ্যতা : বাক্যস্থিত পদসমূহের অন্তর্গত এবং ভাবগত মিলবন্ধনের নাম যোগ্যতা। যেমন – বর্ষার বৃষ্টিতে - প্লাবনের সৃষ্টি হয়। এটি একটি যোগ্যতাসম্পন্ন বাক্য। কারণ, বাক্যটিতে পদসমূহের অর্থগত এবং ভাবগত সমন্বয় রয়েছে।
কিন্তু ‘বর্ষার রৌদ্র প্লাবনের সৃষ্টি করে।' – বললে বাক্যটি ভাবপ্রকাশের যোগ্যতা হারাবে। কারণ, রৌদ্র প্লাবন সৃষ্টি করে না ।
শব্দের যোগ্যতার সঙ্গে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো জড়িত থাকে
(ক) রীতিসিদ্ধ অর্থবাচকতা : প্রকৃতি-প্রত্যয়জাত অর্থে শব্দ সর্বদা ব্যবহৃত হয়। যোগ্যতার দিক থেকে রীতিসিদ্ধ অর্থের প্রতি লক্ষ রেখে কতগুলো শব্দ ব্যবহার করতে হয়। যেমন –

শব্দ                              রীতিসিদ্ধ                                               প্রকৃতি + প্রত্যয়            প্রকৃতি + প্রত্যয়জাত অর্থ
১. বাধিত                       অনুগৃহীত বা কৃতজ্ঞ                                   বাধ + ইত                     বাধাপ্রাপ্ত
২.তৈল                         তিল জাতীয় বিশেষ কোনো শস্যের রস         তিল + ষ্ণ                      তিলজাত স্নেহ পদার্থ

(খ) দুর্বোধ্যতা : অপ্রচলিত, দুর্বোধ্য শব্দ ব্যবহার করলে বাক্যের যোগ্যতা বিনষ্ট হয়। যেমন – তুমি আমার - সঙ্গে প্রপঞ্চ করেছো। (চাতুরী বা মায়া অর্থে, কিন্তু বাংলা ‘প্রপঞ্চ' শব্দটি অপ্রচলিত)।
(গ) উপমার ভুল প্রয়োগ : ঠিকভাবে উপমা অলংকার ব্যবহার না করলে যোগ্যতার হানি ঘটে। যেমন – আমার হৃদয়-মন্দিরে আশার বীজ উপ্ত হলো। বীজ ক্ষেতে বপন করা হয়, মন্দিরে নয়। কাজেই বাক্যটি হওয়া উচিত : আমার হৃদয়-ক্ষেত্রে আশার বীজ উপ্ত হলো ৷
(ঘ) বাহুল্য-দোষ : প্রয়োজনের অতিরিক্ত শব্দ ব্যবহারে বাহুল্য দোষ ঘটে এবং এর ফলে শব্দ তার যোগ্যতাগুণ হারিয়ে থাকে। যেমন –
দেশের সব আলেমগণই এ ব্যাপারে আমাদের সমর্থন দান করেন। ‘আলেমগণ’ বহু বচনবাচক শব্দ। এর সঙ্গে ‘সব' শব্দটির অতিরিক্ত ব্যবহার বাহুল্য দোষ সৃষ্টি করেছে।
(ঙ) বাগধারার শব্দ পরিবর্তন : বাগ্ধারা ভাষাবিশেষের ঐতিহ্য। এর যথেচ্ছ পরিবর্তন করলে শব্দ তার যোগ্যতা
হারায়। যেমন ‘অরণ্যে রোদন' (অর্থ : নিষ্ফল আবেদন)-এর পরিবর্তে যদি বলা হয়।, ‘বনে ক্রন্দন' তবে
বাগধারাটি তার যোগ্যতা হারাবে।
(চ) গুরুচণ্ডালী দোষ : তৎসম শব্দের সঙ্গে দেশীয় শব্দের প্রয়োগ কখনো কখনো গুরুচন্ডালী দোষ সৃষ্টি করে। এ দোষে দুষ্ট শব্দ তার যোগ্যতা হারায়। ‘গরুর গাড়ি’, ‘শবদাহ’, ‘মড়াপোড়া' প্রভৃতি স্থলে যথাক্রমে ‘গরুর শকট’, ‘শবপোড়া’, ‘মড়াদাহ' প্রভৃতির ব্যবহার গুরুচণ্ডালী দোষ সৃষ্টি করে।

 

                                                                                 উদ্দেশ্য ও বিধেয়
প্রতিটি বাক্যে দুটি অংশ থাকে : উদ্দেশ্য ও বিধেয়
বাক্যের যে অংশে কাউকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলা হয়, তাকে উদ্দেশ্য এবং উদ্দেশ্য সম্বন্ধে যা বলা হয়, তাকে বিধেয় বলে। যেমন –
খোকা এখন      বই পড়ছে
(উদ্দেশ্য)        ( বিধেয়)


বিশেষ্য বা বিশেষ্যস্থানীয় অন্যান্য পদ বা পদসমষ্টিযোগে গঠিত বাক্যাংশও বাক্যের উদ্দেশ্য হতে পারে। যেমন –
সৎ লোকেরাই প্রকৃত সুখী       - বিশেষ্যরূপে ব্যবহৃত বিশেষণ ।
মিথ্যা কথা বলা খুবই অন্যায়   - ক্রিয়াজাত বাক্যাংশ ।

উদ্দেশ্যের প্রকারভেদ
• একটিমাত্র পদবিশিষ্ট কর্তৃপদকে সরল উদ্দেশ্য বলে ।
• উদ্দেশ্যের সঙ্গে বিশেষণাদি যুক্ত থাকলে তাকে সম্প্রসারিত উদ্দেশ্য বলে।


উদ্দেশ্যের সম্প্রসারণ :                            সম্প্রসারণ                             উদ্দেশ্য                        বিধেয়

১. বিশেষণ যোগে-                                      কুখ্যাত                                  দস্যুদল                       ধরা পড়েছে।
২. সম্বন্ধ পদযোগে-                                   হাসিমের                                   ভাই                            এসেছে।
৩. সমার্থক বাক্যাংশ যোগে-                      যারা অত্যন্ত পরিশ্রমী,               তারাই                           উন্নতি করে ৷
৪. অসমাপিকা ক্রিয়াবিশেষণ যোগে—       চাটুকার পরিবৃত হয়েই            বড় সাহেব                        থাকেন ৷
৫. বিশেষণ স্থানীয় বাক্যাংশ যোগে—        যার কথা তোমরা বলে থাক,          তিনি                         এসেছেন।


বিধেয়ের সম্প্রসারণ :                                        উদ্দেশ্য             সম্প্রসারণ                   বিধেয়
১. ক্রিয়া বিশেষণ যোগে                                       ঘোড়া                  দ্রুত                            চলে।

২. ক্রিয়া বিশেষণীয় যোগে                                   জেট বিমান         অতিশয় দ্রুত                  চলে।

৩. কারকাদি যোগে-                                           ভুবনের                ঘাটে ঘাটে                      ভাসিছে।
৪. ক্রিয়া বিশেষণ স্থানীয় বাক্যাংশ যোগে-            তিনি                  যে ভাবেই হোক                আসবেন।
৫. বিধেয় বিশেষণ যোগে-                                   ইনি                    আমার বিশেষ                  অন্তরঙ্গ বন্ধু (হন)।

গঠন অনুযায়ী বাক্যের প্রকারভেদ
বাক্য তিন প্রকার : (১) সরল বাক্য, (২) মিশ্র বা জটিল বাক্য, (৩) যৌগিক বাক্য ।
১. সরল বাক্য : যে বাক্যে একটিমাত্র কর্তা (উদ্দেশ্য) এবং একটিমাত্র সমাপিকা ক্রিয়া (বিধেয়) থাকে, তাকে
সরল বাক্য বলে। যথা – পুকুরে পদ্মফুল জন্মে। এখানে ‘পদ্মফুল' উদ্দেশ্য এবং ‘জন্মে’ বিধেয় ।
এ রকম : বৃষ্টি হচ্ছে। তোমরা বাড়ি যাও। খোকা আজ সকালে স্কুলে গিয়েছে। স্নেহময়ী জননী (উদ্দেশ্য ) স্বীয় সন্তানকে প্রাণাপেক্ষা ভালোবাসেন (বিধেয়)। বিশ্ববিখ্যাত মহাকবিরা (উদ্দেশ্য) ঐন্দ্রজালিক শক্তিসম্পন্ন লেখনী দ্বারা অমরতার সঙ্গীত রচনা করেন ( বিধেয়) । :
২. মিশ্র বা জটিল বাক্য : যে বাক্যে একটি প্রধান খণ্ডবাক্যের এক বা একাধিক আশ্রিত বাক্য পরস্পর সাপেক্ষ ভাবে ব্যবহৃত হয়, তাকে মিশ্র বা জটিল বাক্য বলে। যথা—
আশ্রিত বাক্য                       প্রধান খণ্ডবাক্য
১. যে পরিশ্রম করে,            সে-ই সুখ লাভ করে।
২. সে যে অপরাধ করেছে,   তা মুখ দেখেই বুঝেছি।


আশ্রিত খণ্ডবাক্য তিন প্রকার : (ক) বিশেষ্য স্থানীয় আশ্রিত খণ্ডবাক্য, (খ) বিশেষণ স্থানীয় আশ্রিত খণ্ডবাক্য, (গ) ক্রিয়া বিশেষণ স্থানীয় আশ্রিত খণ্ডবাক্য ।

ক. বিশেষ্য স্থানীয় আশ্রিত খণ্ডবাক্য (Noun clause ) : যে আশ্রিত খণ্ডবাক্য (Subordinate clause) প্রধান খণ্ডবাক্যের যে কোনো পদের আশ্রিত থেকে বিশেষ্যের কাজ করে, তাকে বিশেষ্যস্থানীয় আশ্রিত খণ্ডবাক্য বলে। যথা : —আমি মাঠে গিয়ে দেখলাম, খেলা শেষ হয়ে গিয়েছে। (বিশেষ্য স্থানীয় খণ্ডবাক্য ক্রিয়ার কর্মরূপে ব্যবহৃত
তদ্রুপ : তিনি বাড়ি আছেন কি না, আমি জানি না। ব্যাপারটি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলে ফল ভালো হবে না ৷
(খ) বিশেষণ স্থানীয় আশ্রিত খণ্ডবাক্য (Adjective clause ) : যে আশ্রিত খণ্ডবাক্য প্রধান খণ্ডবাক্যের অন্তর্গত কোনো বিশেষ্য বা সর্বনামের দোষ, গুণ এবং অবস্থা প্রকাশ করে, তাকে বিশেষণ স্থানীয় আশ্রিত খণ্ডবাক্য বলে। যথা :
—লেখাপড়া করে যেই, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সেই। (আশ্রিত বাক্যটি ‘সেই’ সর্বনামের অবস্থা প্রকাশ করছে)।
তদ্রুপ : ‘খাঁটি সোনার চাইতে খাঁটি, আমার দেশের মাটি' ।
‘ধনধান্য পুষ্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা।’ যে এ সভায় অনুপস্থিত, সে বড় দুর্ভাগা
গ) ক্রিয়া-বিশেষণ স্থানীয় খণ্ডবাক্য (Adverbial clause ) : যে আশ্রিত খণ্ডবাক্য ক্রিয়াপদের স্থান, কাল ও কারণ নির্দেশক অর্থে ব্যবহৃত হয় তাকে ক্রিয়া-বিশেষণ স্থানীয় আশ্রিত খণ্ডবাক্য বলে। যেমন -
‘যতই করিবে দান, তত যাবে বেড়ে। ’
তুমি আসবে বলে আমি অপেক্ষা করছি।
যেখানে আকাশ আর সমুদ্র একাকার হয়ে গেছে, সেখানেই দিকচক্রবাল।
৩. যৌগিক বাক্য : পরস্পর নিরপেক্ষ দুই বা ততোধিক সরল বা মিশ্র বাক্য মিলিত হয়ে একটি সম্পূর্ণ বাক্য গঠন করলে তাকে যৌগিক বাক্য বলে।
জ্ঞাতব্য : যৌগিক বাক্যের অন্তর্গত নিরপেক্ষ বাক্যগুলো এবং, ও, কিন্তু, অথবা, অথচ, কিংবা, বরং, তথাপি প্রভৃতি অব্যয় যোগে সংযুক্ত বা সমন্বিত থাকে। যেমন –
নেতা জনগণকে উৎসাহিত করলেন বটে, কিন্তু, কোনো পথ দেখাতে পারলেন না। বসত্ৰ মলিন কেন, কেহ জিজ্ঞাসা করিলে সে ধোপাকে গালি পাড়ে, অথচ ধৌত বস্ত্রে তাহার গৃহ পরিপূর্ণ। উদয়াস্ত পরিশ্রম করব, তথাপি অন্যের দ্বারস্থ হব না। 


                                                                                           বাক্য রূপান্তর
অর্থের কোনোরূপ রূপান্তর না করে এক প্রকারের বাক্যকে অন্য প্রকার বাক্যে রূপান্তর করার নামই বাক্য রূপান্তর।

ক. সরল বাক্যকে মিশ্র বাক্যে রূপান্তর
সরল বাক্যকে মিশ্র বাক্যে পরিণত করতে হলে সরল বাক্যের কোনো অংশকে খণ্ডবাক্যে পরিণত করতে হয় এবং উভয়ের সংযোগ বিধানে সম্বন্ধসূচক (যদি, তবে, যে, সে প্রভৃতি) পদের সাহায্যে উক্ত খণ্ডবাক্য ও প্রধান বাক্যটিকে পরস্পর সাপেক্ষ করতে হয়। যথা :
১. সরল বাক্য     : ভালো ছেলেরা শিক্ষকের আদেশ পালন করে ৷
মিশ্র বাক্য          :যারা ভালো ছেলে, তারা শিক্ষকের আদেশ পালন করে।


২. সরল বাক্য     :তার দর্শনমাত্রই আমরা প্রস্থান করলাম।

    মিশ্র বাক্য      :           যে-ই তার দর্শন পেলাম, সে-ই আমরা প্রস্থান করলাম।
৩. সরল বাক্য  : ভিক্ষুককে দান কর।
    মিশ্র বাক্য    :যে ভিক্ষা চায়, তাকে দান কর।


খ. মিশ্র বাক্যকে সরল বাক্যে রূপান্তর : মিশ্র বাক্যকে সরল বাক্যে রূপান্তর করতে হলে মিশ্র বাক্যের অপ্রধান খণ্ডবাক্যটিকে সংকুচিত করে একটি পদ বা একটি বাক্যাংশে পরিণত করতে হয়। যথা :
১. মিশ্র বাক্য            যাদের বুদ্ধি নেই, তারাই এ কথা বিশ্বাস করবে।
   সরল বাক্য            নির্বোধরা/বুদ্ধিহীনরা এ কথা বিশ্বাস করবে।
২. মিশ্র বাক্য : যতদিন জীবিত থাকব, ততদিন এ ঋণ স্বীকার করব।
     সরল বাক্য: আজীবন এ ঋণ স্বীকার করব।
৩. মিশ্র বাক্য :যে সকল পশু মাংস ভোজন করে, তারা অত্যন্ত বলবান।
    সরল বাক্য :মাংসভোজী পশু অত্যন্ত বলবান ৷


গ. সরল বাক্যকে যৌগিক বাক্যে রূপান্তর
সরল বাক্যকে যৌগিক বাক্যে পরিণত করতে হলে সরল বাক্যের কোনো অংশকে নিরপেক্ষ বাক্যে রূপান্তর করতে হয়। এবং যথাসম্ভব সংযোজক বা বিয়োজক অব্যয়ের প্রয়োগ করতে হয়। যেমন –
১. সরল বাক্য      : তিনি আমাকে পাঁচ টাকা দিয়ে বাড়ি যেতে বললেন।
  যৌগিক বাক্য    : তিনি আমাকে পাঁচটি টাকা দিলেন এবং বাড়ি যেতে বললেন।
২. সরল বাক্য      : পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য এখন থেকেই তোমার পড়া উচিত।      
     যৌগিক বাক্য :এখন থেকেই তোমার পড়া উচিত, তবেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারবে।

৩. সরল বাক্য    : আমি বহু কষ্টে শিক্ষা লাভ করেছি।
    যৌগিক বাক্য: আমি বহু কষ্ট করেছি, ফলে শিক্ষা লাভ করেছি।

ঘ. যৌগিক বাক্যকে সরল বাক্যে রূপান্তর করতে হলে
(১) বাক্যসমূহের একটি সমাপিকা ক্রিয়াকে অপরিবর্তিত রাখতে হয়।
(২) অন্যান্য সমাপিকা ক্রিয়াকে অসমাপিকা ক্রিয়ায় পরিণত করতে হয়।
(৩) অব্যয় পদ থাকলে তা বর্জন করতে হয় ।
(৪) কোনো কোনো স্থলে একটি বাক্যকে হেতুবোধক বাক্যাংশে পরিণত করতে হয়। যথা :
(১) যৌগিক বাক্য   সত্য কথা বলিনি, তাই বিপদে পড়েছি।

     সরল বাক্য      : সত্য কথা না বলে বিপদে পড়েছি।
(২) যৌগিক বাক্য : তার বয়স হয়েছে, কিন্তু বুদ্ধি হয়নি।
      সরল বাক্য    : তার বয়স হলেও বুদ্ধি হয়নি ।
(৩) যৌগিক বাক্য :মেঘ গর্জন করে, তবে ময়ূর নৃত্য করে।
     সরল বাক্য   : মেঘ গর্জন করলে ময়ূর নৃত্য করে।


ঙ. যৌগিক বাক্যকে মিশ্র বাক্যে রূপান্তর

যৌগিক বাক্যের অন্তর্গত পরস্পর নিরপেক্ষ বাক্য দুটির প্রথমটির পূর্বে ‘যদি’ কিংবা ‘যদিও’ এবং দ্বিতীয়টির পূর্বে ‘তাহলে’ (তাহা হইলে) কিংবা ‘তথাপি’ অব্যয়গুলো ব্যবহার করতে হয়। যেমন –
(১) যৌগিক বাক্য  : দোষ স্বীকার কর, তোমাকে কোনো শাস্তি দেব না ৷
         মিশ্র বাক্য   :যদি দোষ স্বীকার কর, তাহলে তোমাকে কোনো শাস্তি দেব না ৷
(২) যৌগিক বাক্য    : তিনি অত্যন্ত দরিদ্র কিন্তু তাঁর অন্তঃকরণ অতিশয় উচ্চ।
    মিশ্র বাক্য           :যদিও তিনি অত্যন্ত দরিদ্র, তথাপি তাঁর অন্তঃকরণ অতিশয় উচ্চ।

সাপেক্ষ অব্যয়ের সাহায্যেও যৌগিক বাক্যকে মিশ্র বাক্যে পরিবর্তন করা যায়। যথা :
যৌগিক বাক্য    :এ গ্রামে একটি দরগাহ আছে, সেটি পাঠানযুগে নির্মিত হয়েছে।

 মিশ্র বাক্য        :এ গ্রামে যে দরগাহ আছে, সেটি পাঠানযুগে নির্মিত হয়েছে।

চ. মিশ্রবাক্যকে যৌগিক বাক্যে রূপান্তর
মিশ্র বাক্যকে যৌগিক বাক্যে পরিবর্তন করতে হলে খণ্ডবাক্যগুলোকে এক একটি স্বাধীন বাক্যে পরিবর্তন করে তাদের মধ্যে সংযোজক অব্যয়ের ব্যবহার করতে হয়। যেমন (১) মিশ্র বাক্য      : যদি সে কাল আসে, তাহলে আমি যাব।
   যৌগিক বাক্য : সে কাল আসবে এবং আমি যাব ।
(২) মিশ্র বাক্য  :যখন বিপদ আসে, তখন দুঃখও আসে।
    যৌগিক বাক্য  : বিপদ এবং দুঃখ এক সময়ে আসে ৷
(৩) মিশ্র বাক্য  : যদিও তাঁর টাকা আছে, তথাপি তিনি দান করেন না।
    যৌগিক বাক্য: তাঁর টাকা আছে, কিন্তু তিনি দান করেন না।

বাক্য বিশ্লেষণ
সংজ্ঞা : বাক্যের বিভিন্ন অংশ পৃথক করে তাদের পারস্পরিক সম্বন্ধ নির্ণয় প্রণালীকে বাক্য বিশ্লেষণ বলে।
ক. সরল বাক্যের বিশ্লেষণ
১. মহারাজ শুদ্ধোদনের পুত্র শাক্যসিংহ যৌবনে সংসার ত্যাগ করেন।
২. ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা) দীন ইসলামের জন্য তাঁর যথাসর্বস্ব দান করেছিলেন।

ওপরে লিখিত বাক্য দুটিকে (১) উদ্দেশ্য, (২) উদ্দেশ্যের সম্প্রসারক, (৩) বিধেয়, (৪) বিধেয়ের সম্প্রসারক - এ চারটি অংশে বিশ্লেষণ করতে হবে।

খ. মিশ্র বাক্যের বিশ্লেষণ
মিশ্র বাক্যের বিশ্লেষণ করতে হলে
১. প্রথমে প্রধান বাক্যটি প্রদর্শন করতে হয়।
২. খণ্ডবাক্য (গুলো) প্রদর্শন করে তাদের সঙ্গে প্রধান বাক্যের সম্বন্ধ উল্লেখ করতে হয়।
৩. প্রধান এবং অপ্রধান খণ্ডবাক্যের মধ্যে কোনো সংযোজক পদ থাকলে তাও দেখাতে হয়। যেমন-আমি স্থির করলাম যে, এরূপ অল্প বয়স্ক বালককে পাঠাব না। এখানে প্রধান বাক্য-(১) আমি স্থির করলাম; সংযোজক পদ-যে; বিশেষ্য-স্থানীয় খণ্ডবাক্য – (২) অল্প বয়স্ক বালককে পাঠাব না।

গ. যৌগিক বাক্যের বিশ্লেষণ
যৌগিক বাক্যের বিশ্লেষণ করতে হলে
১. প্রত্যেকটি স্বাধীন বা নিরপেক্ষ বাক্যকে সরল বাক্যের ন্যায় বিশ্লেষণ করতে হবে।
২. কোনো সংযোজক অব্যয় থাকলে তা প্রদর্শন করতে হবে। যেমন পরিচালিত করে। এখানে দুটি বাক্য আছে। যেমন ত্যাগ এবং জ্ঞান মানুষকে মুক্তির পথে
(১) ত্যাগ মানুষকে মুক্তির পথে পরিচালিত করে।
(২) জ্ঞান মানুষকে মুক্তির পথে পরিচালিত করে। বাক্য দুটির সংযোজক অব্যয় ‘এবং’।

                                                                      বাক্য সংক্ষেপণ
একাধিক পদ বা উপবাক্যকে একটি শব্দে প্রকাশ করা হলে, তাকে বাক্য সংক্ষেপণ বলে। এটি বাক্য সংকোচন বা এক কথায় প্রকাশেরই নামান্তর । এখানে বাক্য সংকোচনের উদাহরণ দেওয়া গেল।
বাক্য সংক্ষেপণের বা বাক্য সংকোচনের উদাহরণ


অকালে পক্ক হয়েছে যা – অকালপক্ক
অক্ষির সমক্ষে বর্তমান – প্রত্যক্ষ।
অভিজ্ঞতার অভাব আছে যার – অনভিজ্ঞ।
অহংকার নেই যার - নিরহংকার।
অনেকের মধ্যে একজন – অন্যতম ।
অনুতে (বা পশ্চাতে) জন্মেছে যে – অনুজ । -
আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত – আদ্যন্ত, আদ্যোপান্ত । -
আকাশে বেড়ায় যে – আকাশচারী, খেচর।
আচারে নিষ্ঠা আছে যার – আচারনিষ্ঠ। -
আপনাকে কেন্দ্র করে যার চিন্তা – আত্মকেন্দ্রিক। আপনাকে যে পণ্ডিত মনে করে—পণ্ডিতম্মন্য।
আল্লাহ্র অস্তিত্বে বিশ্বাস আছে যার – আস্তিক।

আল্লাহ্র অস্তিত্বে বিশ্বাস নেই যার - নাস্তিক।
ইতিহাস রচনা করেন যিনি – ঐতিহাসিক
ইতিহাস বিষয়ে অভিজ্ঞ যিনি – ইতিহাসবেত্তা ৷
ইন্দ্রিয়কে জয় করেছে যে – জিতেন্দ্রিয়।
ঈষৎ আমিষ (আঁষ) গন্ধ যার – আঁষটে।
উপকারীর উপকার যে স্বীকার করে – কৃতজ্ঞ।
উপকারীর উপকার যে স্বীকার করে না - অকৃতজ্ঞ ।
উপকারীর অপকার করে যে – কৃতঘ্ন। 
একই মাতার উদরে জাত যে -সহোদর।
এক থেকে শুরু করে ক্রমাগত – একাদিক্রমে ।
কর্ম সম্পাদনে পরিশ্রমী – কর্মঠ। -
কোনো ভাবেই যা নিবারণ করা যায় না – অনিবার্য।
চক্ষুর সম্মুখে সংঘটিত —চাক্ষুষ।
জীবিত থেকেও যে মৃত – জীবস্মৃত।
তল স্পর্শ করা যায় না যার অতলস্পর্শী।
দিনে যে একবার আহার করে – একাহারী। 
নষ্ট হওয়াই স্বভাব যার – নশ্বর । 
নদী মেখলা যে দেশের – নদীমেখলা ।
নৌকা দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করে যে – নাবিক । 
পা থেকে মাথা পর্যন্ত – আপাদমস্তক।
ফল পাকলে যে গাছ মরে যায় – ওষধি।
বিদেশে থাকে যে – প্রবাসী ।
বিশ্বজনের হিতকর – বিশ্বজনীন । -
মৃতের মতো অবস্থা যার – মুমূর্ষু।
যা দমন করা যায় না - অদম্য।
যা দমন করা কষ্টকর – দুর্দমনীয় । -
যা নিবারণ করা কষ্টকর - দুর্নিবার। যা পূর্বে ছিল এখন নেই – ভূতপূর্ব। 
যার উপস্থিত বুদ্ধি আছে – প্রত্যুৎপন্নমতি।

যার সর্বস্ব হারিয়ে গেছে – সর্বহারা, হৃতসর্বস্ব। যার কোনো কিছু থেকেই ভয় নেই – অকুতোভয়
যার আকার কুৎসিত – কদাকার ৷
যা বিনা যত্নে লাভ করা গিয়েছে – অযত্নলব্ধ । -
যা বার বার দুলছে - দোদুল্যমান।
যা দীপ্তি পাচ্ছে – দেদীপ্যমান ৷
যা সাধারণের মধ্যে দেখা যায় না এমন-অনন্যসাধারণ।
যা পূর্বে দেখা যায়নি এমন – অদৃষ্টপূর্ব। যা কষ্টে জয় করা যায় – দুর্জয়।
যা কষ্টে লাভ করা যায় – দুর্লভ।
যা অধ্যয়ন করা হয়েছে - . অধীত
যা জলে চরে – জলচর।
যা স্থলে চরে- স্থলচর।
যা জলে ও স্থলে চরে - উভচর।
যা বলা হয়নি -অনুক্ত।
যা কখনো নষ্ট হয় না – অবিনশ্বর । -
যা মর্ম স্পর্শ করে – মর্মস্পর্শী।
যা বলার যোগ্য নয় – অকথ্য।
যা অতি দীর্ঘ নয় – নাতিদীর্ঘ।
যার বংশ পরিচয় এবং স্বভাব কেউই জানে না – অজ্ঞাতকুলশীল।
যার প্রকৃত বর্ণ ধরা যায় না – বর্ণচোরা।
যা চিন্তা করা যায় না অচিন্তনীয়, অচিন্ত্য।
যা কোথাও উঁচু কোথাও নিচু-বন্ধুর
যা সম্পন্ন করতে বহু ব্যয় হয়-ব্যয়বহুল ।
যা খুব শীতল বা উষ্ণ নয় – নাতিশীতোষ্ণ। -
যার বিশেষ খ্যাতি আছে – বিখ্যাত।
যা আঘাত পায়নি-অনাহত।
যা উদিত হচ্ছে – উদীয়মান।
যার অন্য উপায় নেই - অনন্যোপায়।
যার কোনো উপায় নেই – নিরুপায় ৷

যা ক্রমশ বর্ধিত হচ্ছে- বর্ধিষ্ণু।
যা পূর্বে শোনা যায়নি – অশ্রুতপূর্ব।
যে শুনেই মনে রাখতে পারে – শ্রুতিধর। যে বাস্তু থেকে উৎখাত হয়েছে – উদ্বাস্তু।
যে নারী নিজে বর বরণ করে নেয় – স্বয়ংবরা। -
যে গাছে ফল ধরে, কিন্তু ফুল ধরে না - বনস্পতি ।
যে রোগ নির্ণয় করতে হাতড়ে মরে – হাতুড়ে।
যে নারীর সন্তান বাঁচে না – মৃতবৎসা । 
যে গাছ কোনো কাজে লাগে না – আগাছা ৷
যে গাছ অন্য গাছকে আশ্রয় করে বাঁচে-পরগাছা ৷
যে পুরুষ বিয়ে করেছে – কৃতদার।
যে মেয়ের বিয়ে হয়নি – অনূঢ়া ৷
যে ক্রমাগত রোদন করছে – রোরুদ্যমান । 
যে ভবিষ্যতের চিন্তা করে না বা দেখে না- অপরিণামদর্শী।
যে ভবিষ্যৎ না ভেবেই কাজ করে – অবিমৃষ্যকারী।
যে বিষয়ে কোনো বিতর্ক (বা বিসংবাদ) নেই – অবিসংবাদিত।
যে বন হিংস্র জন্তুতে পরিপূর্ণ – শ্বাপদসংকুল।
যিনি বক্তৃতা দানে পটু – বাগ্মী।
যে সকল অত্যাচারই সয়ে যায় – সর্বংসহা।
যে নারী বীর সন্তান প্রসব করে – বীরপ্রসূ।
যে নারীর কোনো সন্তান হয় না - বন্ধ্যা।
যে নারী জীবনে একমাত্র সন্তান প্রসব করেছে – কাকবন্ধ্যা। যে পুরুষের চেহারা দেখতে সুন্দর - সুদর্শন।
যে রব শুনে এসেছে – রবাহুত।
লাভ করার ইচ্ছা – লিপ্সা ।
শুভ ক্ষণে জন্ম যার - ক্ষণজন্মা ।
সম্মুখে অগ্রসর হয়ে অভ্যর্থনা – প্রত্যুদ্‌গমন । 
সকলের জন্য প্রযোজ্য – সর্বজনীন।
হনন করার ইচ্ছা – জিঘাংসা। -

Content added || updated By

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : শব্দের যোগ্যতার বিকাশ ও বাগধারা

বাংলা ভাষায় এমন বহু শব্দ আছে, যাদের আভিধানিক অর্থের সঙ্গে ব্যবহারিক অর্থের যথেষ্ট প্রভেদ আছে। বহুভাবে এ ধরনের পার্থক্য দৃষ্ট হয়ে থাকে। যেমন—
(১) শিষ্টরীতি বা রীতিসিদ্ধ প্রয়োগঘটিত : ছাত্রটির মাথা ভালো। এখানে ‘মাথা’ বলতে ‘দেহের অঙ্গবিশেষ' বোঝায় না, বোঝায় ‘মেধা’।
(২) শব্দের অর্থ সংকোচে : ইনি আমার বৈবাহিক। এখানে ‘বৈবাহিক’ শব্দে ‘বিবাহ সূত্রে সম্পর্কিত' অর্থ না বুঝিয়ে ‘ছেলে বা মেয়ের শ্বশুর সম্পর্কিত' ব্যক্তিকে বোঝাচ্ছে ।
(৩) শব্দের অর্থান্তর প্রাপ্তিতে : মেয়ের শ্বশুরবাড়ি তত্ত্ব পাঠানো হয়েছে। এখানে ‘তত্ত্ব' শব্দটির আভিধানিক অর্থ ‘সংবাদ’ না বুঝিয়ে ‘উপঢৌকন’ অর্থ বোঝাচ্ছে। একে নতুন অর্থের আবির্ভাব বলা চলে ৷
(৪) শব্দের উৎকর্ষ প্রাপ্তিতে : শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস। এখানে ‘পরমহংস' শব্দের সঙ্গে হাঁসের কোনো সম্পর্ক নেই, এর অর্থ ‘সন্ন্যাসী’।
(৫) শব্দের অপকর্ষ (বা অধোগতি) বোঝাতে : জ্যাঠামি করো না। এখানে ‘জ্যাঠামি' শব্দের সঙ্গে ‘জ্যাঠা’র
(পিতার বড় ভাইয়ের) কোনো সম্পর্ক নেই; শব্দটি ‘ধৃষ্টতা’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।


কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, শব্দের ব্যবহার দুই প্রকার : (১) বাচ্যার্থ ও (২) লক্ষ্যার্থ।
১. বাচ্যার্থ : যে সকল শব্দ তাদের আভিধানিক অর্থে ব্যবহৃত হয়, আভিধানিক অর্থই তাদের বাচ্যার্থ ।
২. লক্ষ্যার্থ : যে সকল শব্দ তাদের আভিধানিক অর্থে ব্যবহৃত না হয়ে, অন্য অর্থে ব্যবহৃত হয়, অর্থগুলো তাদের লক্ষ্যার্থ। ঐ অন্য অর্থগুলো তাদের লক্ষ্যার্থ।

বাগ্ধারা বা বাক্যরীতি

কোনো শব্দ বা শব্দ-সমষ্টি বাক্যে ব্যবহৃত হয়ে অর্থের দিক দিয়ে যখন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হয়ে ওঠে, তখন সে সকল শব্দ বা শব্দ-সমষ্টিকে বাগ্ধারা বা বাক্যরীতি বলা হয়।
‘মুখ' শব্দযোগে বাগ্‌ধারার উদাহরণ


(ক) এ ছেলে বংশের মুখ রক্ষা করবে......... (সম্মান বাঁচানো)
(খ) শুধু শুধু ছেলেটাকে মুখ করছ কেন?......(গালমন্দ করা)
(গ) এবার গিন্নির মুখ ছুটেছে।............(গালিগালাজের আরম্ভ)
(ঘ) টক খেয়ে মুখ ধরে আসছে।........(মুখের স্বাদ নষ্ট হওয়া)
(ঙ) খোদা মুখ তুলে চাইলে অবশ্যই ব্যবসায়ে লাভ হবে।........(অনুগ্রহ লাভ করা)

 বিশেষ্য শব্দের প্রয়োগভেদে অর্থ পার্থক্য
১. হাত


(ক) হাত আসা- কাজ করতে করতেই কাজে হাত আসবে। (দক্ষতা)
(খ) হাত গুটান-হাত গুটিয়ে বসে আছ কেন? (কার্যে বিরতি)
(গ) হাত করা- সাহেবকে হাত করতে পারলেই কাজ হবে। (আয়ত্তে আনা)
(ঘ) হাত ছাড়া -টাকাগুলো হাত ছাড়া করো না। (হস্তচ্যুত)
(ঙ) হাত থাকা-এ ব্যাপারে আমার কোনো হাত নেই। (প্রভাব )


দ্রষ্টব্য : বাগ্‌ধারা গঠনে বিভিন্ন পদের ব্যবহারকে রীতিসিদ্ধ প্রয়োগও বলে ৷


‘হাত' শব্দের রীতিসিদ্ধ প্রয়োগ


(ক) হাতের পাঁচ (শেষ সম্বল) : এ টাকা কটিই ছিল আমার হাতের পাঁচ ।
(খ) হাতে হাতে (অবিলম্বে): হাতে হাতে এ কাজের ফল পাবেন।
(গ) হাতে খড়ি (বিদ্যারম্ভ): এ মাসেই খোকার হাতে খড়ি হবে।
(ঘ) হাতে কলমে (স্বহস্তে, কার্যকর ভাবে) :হাতে-কলমে শিক্ষা কেতাবি শিক্ষার চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী।


২. মাথা


(ক) মাথা ধরা - রোগ বিশেষ
(খ) গাঁয়ের মাথা - মোড়ল।
(গ) মাথা ব্যথা -আগ্রহ
(ঘ) মাথা খাওয়া -শপথ করা।
(ঙ) মাথা দেওয়া -দায়িত্ব গ্রহণ
(ছ) মাথাপিছু-জনপ্রতি
(চ) মাথা ঘামানো-ভাবনা করা।


মাথা শব্দের রীতিসিদ্ধ প্রয়োগ                                                           বাক্য গঠন
রাস্তার মাথায়              -মিলন স্থলে ৷                                       রাস্তার মাথায় তার সঙ্গে দেখা।

মাথা গরম করা          -রাগান্বিত হওয়া ।                               মাথা গরম করে আর কী হবে?
রাগের মাথায়            - হঠাৎ ক্রোধবশত।                             রাগের মাথায় কথাটা বলেছি।

মাথা হেঁট করা         -লজ্জায় মাথা নিচু করা।                        মাথা হেঁট হবে কেন ?
মাথা উঁচু করে চলা   - গর্বভরে চলা ৷                             মাথা উঁচু করেই চলতে চাই।

বিশেষণ শব্দের রীতিসিদ্ধ প্রয়োগ


১. কাঁচা


কাঁচা আম-অপরিপক্ক আম ।
কাঁচা খাতা - খসড়া।
কাঁচা কথা-গুরুত্বহীন কথা
কাঁচা ইট -অদগ্ধ ইট।
কাঁচা ঘুম -অল্প ক্ষণের ঘুম।
কাঁচা বয়স-অপরিণত বয়স।
কাঁচা চুল-কালো চুল।


বাক্য গঠন : কাঁচা সোনার মতো তার গায়ের রং।


কাঁচা (আনাড়ি) লোকই কাঁচা (অনিপুণভাবে) কাজ করে থাকে।


বাক্যে ‘পাকা' বিশেষণ শব্দের রীতিসিদ্ধ প্ৰয়োগ

পাকা কথা (শেষ সিদ্ধান্তসূচক) চাই ।
পাকা বন্দোবস্ত (স্থায়ী) করে এসেছি। এ হচ্ছে পাকা রাঁধুনির (দক্ষ) রান্না ।
ইঁচড়ে পাকা (অকালে পরিপক্ব) ছেলেদের কথা অসহ্য।
একেবারে পাকা হাতের (দক্ষ লেখকের) লেখা।


আমি কি তোমার পাকা ধানে মই দিয়েছি (হক নষ্ট করা) যে, আমার সঙ্গে শত্রুতা করছ?


‘করা' ক্রিয়াপদের রীতিসিদ্ধ প্রয়োগ

মনে করলাম এবার তীর্থে যাব। (সংকল্প করা)
সে ফুটবল খেলায় নাম করেছে। (যশস্বী হওয়া
টাকা করে নাম কিনতে চাও? (খ্যাতি লাভের চেষ্টা করা)
চাকরি পাওয়ার কোনো জো করে উঠতে পারিনি। (সুযোগ পাওয়া)

'ধরা' ক্রিয়াপদের রীতিসিদ্ধ প্রয়োগ


কান ধরা-কর্ণ মর্দন করা।
দোষ ধরা-অপরাধ গণনা করা ।
মনে ধরা-পছন্দ হওয়া।
আগুন ধরা-আগুন লাগা ।
পথ ধরা-উপায় দেখা ।
ম্যাও ধরা-দায়িত্ব নেওয়া ।
গোঁ ধরা-একগুঁয়েমি করা।
হাতে-পায়ে ধরা - অনুরোধ করা।
গলা ধরা-কণ্ঠ রুদ্ধ হওয়া। (কথা বন্ধ হয়ে যাওয়া)

দ্রষ্টব্য : শব্দাত্মক ও পদাত্মক বাগ্ধারার অর্থের পার্থক্য ঘটে। যেমন—

গা সওয়া -অভ্যস্ত হওয়া

গায়ে সওয়া - দেহে সহ্য হওয়া ।

গা লাগা -মনোযোগ দেওয়া ।

গায়ে লাগা-অনুভূত হওয়া। -


পায়ে পড়া-ক্ষমা প্রার্থনা করা।

পায় পড়া-খোশামুদে ৷
হাত আসা- অভ্যস্থ হওয়া।
হাতে আসা- আয়ত্ত হওয়া।
রোগ ধরা -রোগ নির্ণয়
রোগে ধরা-রোগাক্রান্ত হওয়া ।

বাগ্ধারার ব্যবহার

অকাল কুষ্মাণ্ড (অপদার্থ, অকেজো)-অকাল কুষ্মাণ্ড ছেলেটার ওপর এ কাজের দায়িত্ব দিও না।
অক্কা পাওয়া (মারা যাওয়া)-অনেক রোগভোগের পর শয়তানটা শেষ পর্যন্ত অক্কা পেয়েছে।
অগস্ত্য যাত্রা (চিরদিনের জন্য প্রস্থান)-ডাকাতি মামলার আসামি হওয়ায় করিম গ্রাম থেকে অগস্ত্য যাত্রা করেছে।
অগাধ জলের মাছ (সুচতুর ব্যক্তি)-সরল মনে হলেও লোকটা আসলে অগাধ জলের মাছ ।
অর্ধচন্দ্ৰ (গলা ধাক্কা)-শয়তানটাকে অর্ধচন্দ্র দিয়ে বিদায় করে দাও ।
অন্ধের ষষ্ঠি-বিধবার একমাত্র সন্তান তার অন্ধের ষষ্ঠি/অন্ধের নড়ি।
অন্ধের নড়ি (একমাত্র অবলম্বন)-বিধবার একমাত্র সন্তান তার অন্ধের ষষ্ঠি/অন্ধের নড়ি।
অগ্নিশর্মা (নিরতিশয় ক্রুদ্ধ )-তিনি ক্রোধে অগ্নিশর্মা হলেন ৷
অগ্নিপরীক্ষা (কঠিন পরীক্ষা)-জাতিকে এ অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতেই হবে, ভয় পেলে চলবে না।

অন্ধকারে ঢিল মারা (আন্দাজে কাজ করা)-অন্ধকারে ঢিল মেরে সব কাজ ঠিকভাবে করা যায় না।
অকূল পাথার (ভীষণ বিপদ) )-অকূল পাথারে আল্লাহ্ই একমাত্র সহায়।
অনুরোধে ঢেঁকি গেলা (অনুরোধে দুরূহ কাজ সম্পন্ন করতে সম্মতি জ্ঞাপন) – অনুরোধে ঢেঁকি গেলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, আমি এ কাজ করতে পারব না ।
অদৃষ্টের পরিহাস (ভাগ্যের নিষ্ঠুরতা) -অদৃষ্টের পরিহাসে রাজাও ভিখারি হয়।
অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী (সামান্য বিদ্যার অহংকার) - কিছুই জানে না, আবার দেমাক কত – অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী আর কি।
অনধিকার চর্চা (সীমার বাইরে পদক্ষেপ)- কারও ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আমি অনধিকার চর্চা করি না।
অরণ্যে রোদন (নিষ্ফল আবেদন)-কৃপণের নিকট চাঁদা চাওয়া অরণ্যে রোদন মাত্র।
অহিনকুল সম্বন্ধ (ভীষণ শত্রুতা )-দুভাইয়ের মধ্যে অহিনকুল সম্বন্ধ 

অন্ধকার দেখা (দিশেহারা হয়ে পড়া)-এ বিপদে আমি যে সব অন্ধকার দেখছি।
অমাবস্যার চাঁদ (দুর্লভ বস্তু)-তোমার দেখা পাওয়াই ভার, অমাবস্যার চাঁদ হয়ে পড়েছ।
আকাশ কুসুম (অসম্ভব কল্পনা)-মূর্খরাই আকাশ কুসুম চিন্তা করে ৷
আকাশ পাতাল (প্রচুর ব্যবধান)-ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে আকাশ পাতাল প্রভেদ ।
আক্কেল সেলামি (নির্বুদ্ধিতার দণ্ড)-বিনা টিকেটে রেলগাড়িতে চড়ে আক্কেল সেলামি দিতে হলো ৷ 
আঙুল ফুলে কলাগাছ (হঠাৎ বড়লোক )-যুদ্ধের বাজারে দেদার টাকা পয়সা কামাই করে অনেকেই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে।
আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া (দুর্লভ বস্তু প্রাপ্তি)- হারানো ছেলেকে ফিরে পেয়ে বাপ-মা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন ।

আদায় কাঁচকলায় (শত্রুতা)-তার সঙ্গে আমার আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক, সে আমার দুশমন ।
আদা জল খেয়ে লাগা (প্রাণপণ চেষ্টা করা)-কাজটি শেষ করার জন্য সে আদা জল খেয়ে লেগেছে।
আক্কেল গুড়ুম (হতবুদ্ধি, স্তম্ভিত)-ইঁচড়ে পাকা ছেলেটার কথা শুনে আমার আক্কেল গুড়ুম ।
আমড়া কাঠের ঢেঁকি (অপদার্থ)-ও হচ্ছে ধনীর দুলাল, আমড়া কাঠের ঢেঁকি, ওকে দিয়ে কিছুই হবে না।
আকাশ ভেঙে পড়া (ভীষণ বিপদে পড়া)-ব্যাংক ফেল করেছে শুনে তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।
আমতা আমতা করা (ইতস্তত করা, দ্বিধা করা)-আমতা আমতা না করে স্পষ্ট কথায় দোষ স্বীকার কর।
আটকপালে (হতভাগ্য)-ছেলেটা এতিম, আটকপালে।
আঠার মাসে বছর (দীর্ঘসূত্রতা)-তোমার তো আঠার মাসে বছর, কোনো কাজই তাড়াতাড়ি করতে পার না।
আলালের ঘরের দুলাল (অতি আদরে বড় লোকের নষ্ট পুত্র)-বড়লোকের ঘরে দু-একজন আলালের ঘরের দুলাল মিলবেই।
আকাশে তোলা (অতিরিক্ত প্রশংসা করা)-চাটুকাররা ধনী ব্যক্তিদের কথায় কথায় আকাশে তোলে ৷
আষাঢ়ে গল্প (আজগুবি কেচ্ছা )চাঁদে যাওয়ার কথাটা একসময় ছিল আষাঢ়ে গল্প ।
ইঁদুর কপালে (নিতান্ত মন্দ ভাগ্য)-আমার মতো ইঁদুর কপালে লোকের দাম এক কানাকড়িও না।
ইঁচড়ে পাকা (অকালপক্ব)-অতবড় মানুষটার সাথে তর্ক করছে, কী ইঁচড়ে পাকা ছেলে বাবা ।
ইতর বিশেষ (পার্থক্য)-সৃষ্টিকর্তার নিকট সব মানুষই সমান, ইতর বিশেষ নেই।
উত্তম মধ্যম (প্রহার, পিটুনি)-গৃহস্থ চোরটাকে উত্তম মধ্যম দিয়ে ছেড়ে দিল।
উড়নচণ্ডী (অমিতব্যয়ী)-এমন উড়নচণ্ডী হলে দুদিনে টাকাকড়ি সব শেষ হবে।
উভয় সংকট-‘শাখের করাত' দেখ 

উলুবনে মুক্ত ছড়ানো (অস্থানে মূল্যবান দ্রব্য ) -তাকে সদুপদেশ দান, উলুবনে মুক্ত ছড়ানোর মতোই নিষ্ফল।
উড়োচিঠি ( বেনামি পত্র)-ডাকাতরা জমিদার বাড়িতে উড়োচিঠি দিয়ে ডাকাতি করেছিল।
উড়ে এসে জুড়ে বসা -(অনধিকারীর অধিকার লোকটার মাতব্বরি দেখলে গা জ্বলে যায়। ও এখানকার লোক নয়, উড়ে এসে জুড়ে বসেছে।
একক্ষুরে মাথা মুড়ানো (একই স্বভাবের)সকলেই একক্ষুরে মাথা মুড়িয়েছে দেখছি, পরীক্ষায় সবাই ফেল করেছে।
একচোখা (পক্ষপাতিত্ব, পক্ষপাতদুষ্ট)-একচোখা লোকের কাছে সুবিচার পাওয়া যায় না ।
এক মাঘে শীত যায় না (বিপদ একবারই আসে না)-আমাকে ফাঁকি দিলে, মনে রেখো, একমাঘে শীত যায় না।
এলোপাতাড়ি (বিশৃঙ্খলা)-এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়লে শত্রুদলের ক্ষতি করতে পারবে না।
এসপার ওসপার (মীমাংসা)-চুপ করে থেকে লাভ কী, এসপার ওসপার একটা করে ফেল।
একাদশে বৃহস্পতি (সৌভাগ্যের বিষয়)এখন তার একাদশে বৃহস্পতি, ধুলোমুঠোও সোনামুঠো হচ্ছে।
এলাহি কাণ্ড (বিরাট আয়োজন)-বড় বাড়িতে বিয়ে, সেতো এক এলাহি কাণ্ড হবে।
কলুর বলদ (একটানা খাটুনি)কলুর বলদের মতো সংসারের চাকায় ঘুরে মরছি।
কথার কথা (গুরুত্বহীন কথা )-কারও মনে আঘাত দেওয়ার জন্য একথা বলিনি, এটা একটা কথার কথা।
কপাল ফেরা (সৌভাগ্য লাভ )-লটারির টিকেট কিনে সে তার কপাল ফেরাতে চায় ৷
কত ধানে কত চাল (হিসাব করে চলা)-নিজেকে তো আর উপার্জন করতে হয় না, কত ধানে কত চাল হয় বুঝবে কেমন করে ।
কড়ায় গণ্ডায় (সম্পূর্ণ, পুরোপুরি)সে কড়ায় গণ্ডায় তার পাওনা বুঝে নিল।
কান খাড়া করা (মনোযোগী হওয়া)আমি কী বলি তা শোনার জন্য সে কান খাড়া করে রইল।
কাঁচা পয়সা (নগদ উপার্জন)-কাঁচা পয়সা পাও কি না, তাই খরচ করতে বাধে না।
কাঁঠালের আমসত্ত্ব (অসম্ভব বস্তু)- ঐ হাড়কিপ্টে করবে দান, কাঁঠালের আমসত্ত্ব আর কি।
কূপমণ্ডুক (ঘরকুনো, সীমাবদ্ধ জ্ঞান সম্পন্ন) তুমি তো কূপমণ্ডূক, ‘ঘরে হৈতে আঙ্গিনা বিদেশ'। 

কেতাদুরস্ত (পরিপাটি কথাবার্তায়, পোশাকপরিচ্ছদে কেতাদুরস্ত হলেও সে অন্তঃসারশূন্য।

Content added || updated By

তৃতীয় পরিচ্ছেদ : বাচ্য এবং বাচ্য পরিবর্তন

১. রবীন্দ্রনাথ ‘গীতাঞ্জলি' লিখেছেন।
২. রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক ‘গীতাঞ্জলি' লিখিত হয়েছে।
৩. আমার খাওয়া হলো না।
ওপরের প্রথম বাক্যে কর্তার, দ্বিতীয় বাক্যে কর্মের, তৃতীয় বাক্যে ক্রিয়ার প্রাধান্য রয়েছে।
বাক্যের বিভিন্ন ধরনের প্রকাশভঙ্গিকে বলা হয় ‘বাচ্য’। বাচ্য প্রধানত তিন প্রকার : (১) কর্তৃবাচ্য (২) কর্মবাচ্য ও (৩) ভাববাচ্য।
কর্তৃবাচ্য : যে বাক্যে কর্তার অর্থ-প্রাধান্য রক্ষিত হয় এবং ক্রিয়াপদ কর্তার অনুসারী হয়, তাকে কর্তৃবাচ্যের বাক্য বলে। যেমন— ছাত্ররা অঙ্ক করছে।
১. কর্তৃবাচ্যে ক্রিয়াপদ সর্বদাই কর্তার অনুসারী হয়।
২.কর্তৃবাচ্যে কর্তায় প্রথমা বা শূন্য বিভক্তি এবং কর্মে দ্বিতীয়া, ষষ্ঠী বা শূন্য বিভক্তি হয়। যথা— শিক্ষক ছাত্রদের পড়ান। রোগী পথ্য সেবন করে।
কর্মবাচ্য : যে বাক্যে কর্মের সাথে ক্রিয়ার সম্বন্ধ প্রধানভাবে প্রকাশিত হয়, তাকে কর্মবাচ্য বলে। যেমন-
শিকারি কর্তৃক ব্যাঘ্র নিহত হয়েছে।
১. কর্মবাচ্যে কর্মে প্রথমা, কর্তায় তৃতীয়া বিভক্তি ও দ্বারা দিয়া (দিয়ে), কর্তৃক অনুসর্গের ব্যবহার এবং ক্রিয়াপদ কর্মের অনুসারী হয়। যথা – আলেকজান্ডার কর্তৃক পারস্য দেশ বিজিত হয়। চোরটা ধরা পড়েছে।
২. কখনো কখনো কর্মে দ্বিতীয়া বিভক্তি হতে পারে। যথা- আসামিকে জরিমানা করা হয়েছে।
ভাববাচ্য : যে বাচ্যে কর্ম থাকে না এবং বাক্যে ক্রিয়ার অর্থই বিশেষভাবে ব্যক্ত হয় তাকে ভাববাচ্য বলে।
১. ভাববাচ্যের ক্রিয়া সর্বদাই নাম পুরুষের হয়। ভাববাচ্যের কর্তায় ষষ্ঠী, দ্বিতীয়া অথবা তৃতীয়া বিভক্তি প্রযুক্ত
হয়। যেমন—
(ক) আমার (কর্তায় ষষ্ঠী) খাওয়া হলো না।                (নাম পুরুষের ক্রিয়া)

(খ) আমাকে (কর্তায় দ্বিতীয়া) এখন যেতে হবে।       (নাম পুরুষের ক্রিয়া)

(গ) তোমার দ্বারা (কর্তায় তৃতীয়) এ কাজ হবে না    (নাম পুরুষের ক্রিয়া)

২. কখনো কখনো ভাববাচ্যে কর্তা উহ্য থাকে, কর্ম দ্বারাই ভাববাচ্য গঠিত হয়। যেমন-
এ পথে চলা যায় না ।
এবার ট্রেনে ওঠা যাক ।
কোথা থেকে আসা হচ্ছে?
৩. মূল ক্রিয়ার সঙ্গে সহযোগী ক্রিয়ার সংযোগ ও বিভিন্ন অর্থে ভাববাচ্যের ক্রিয়া গঠিত হয়। যেমন- এ ব্যাপারে আমাকে দায়ী করা চলে না। এ রাস্তা আমার চেনা নেই ।

                                                                                বাচ্য পরিবর্তন
কর্তৃবাচ্য থেকে কর্মবাচ্য
নিয়ম : কর্তৃবাচ্যের বাক্যকে কর্মবাচ্যে পরিবর্তিত করতে হলে- (১) কর্তায় তৃতীয়া (২) কর্মে প্রথমা বা শূন্য বিভক্তি এবং (৩) ক্রিয়া কর্মের অনুসারী হয়।
জ্ঞাতব্য : কর্তৃবাচ্যের ক্রিয়া অকর্মক হলে সেই বাক্যের কর্মবাচ্য হয় না।
কর্তৃবাচ্য                                                         কর্মবাচ্য
(ক) বিদ্বানকে সকলেই আদর করে।             (ক) বিদ্বান সকলের দ্বারা আদৃত হন।
(খ) খোদাতায়ালা বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন।    (খ) বিশ্বজগৎ খোদাতায়ালা কর্তৃক সৃষ্ট হয়েছে।
(গ) মুবারক পুস্তক পাঠ করছে।                 (গ) মুবারক কর্তৃক পুস্তক পঠিত হচ্ছে।
লক্ষণীয় : কর্তৃবাচ্যে ব্যবহৃত তৎসম মিশ্রক্রিয়াটি কর্মবাচ্যে যৌগিক ক্রিয়াজাত ক্রিয়াবিশেষণ রূপে ব্যবহৃত হয় ।
কর্তৃবাচ্য থেকে ভাববাচ্য
নিয়ম কর্তৃবাচ্যের বাক্যকে ভাববাচ্যে পরিবর্তিত করতে হলে- :
(১) কর্তায় ষষ্ঠী বা দ্বিতীয়া বিভক্তি হয় এবং (২) ক্রিয়া নাম পুরুষের হয়। যেমন-
কর্তৃবাচ্য                                          ভাববাচ্য
(ক) আমি যাব না।                          (ক) আমার যাওয়া হবে না।
(খ) তোমাকেই ঢাকা যেতে হবে।      (খ) তুমিই ঢাকা যাবে।
(গ) তোমরা কখন এলে?                 (গ) তোমাদের কখন আসা হলো?

কর্মবাচ্য থেকে কর্তৃবাচ্য
নিয়ম : কর্মবাচ্যের বাক্যকে কর্তৃবাচ্যে পরিবর্তিত করতে হলে-
(১) কর্তায় প্রথমা, কর্মে দ্বিতীয়া বা শূন্য বিভক্তি প্রযুক্ত হয় এবং (২) ক্রিয়া কর্তা অনুযায়ী হয়। যেমন—
কর্মবাচ্য                                                   কর্তৃবাচ্য
(ক) দস্যুদল কর্তৃক গৃহটি লুণ্ঠিত হয়েছে।    ক) দস্যুদল গৃহটি লুণ্ঠন করেছে।

(খ) হালাকু খাঁ কর্তৃক বাগদাদ বিধ্বস্ত হয়।  (খ) হালাকু খাঁ বাগদাদ ধ্বংস করেন।

ভাববাচ্য থেকে কর্তৃবাচ্য
নিয়ম : ভাববাচ্যের বাক্যকে কর্তৃবাচ্যে রূপান্তরিত করতে হলে-
(১) কর্তায় প্রথমা বিভক্তি প্রযুক্ত হয় এবং (২) ক্রিয়া কর্তার অনুসারী হয়। যেমন-
ভাববাচ্য                                           কর্তৃবাচ্য
(ক) তোমাকে হাঁটতে হবে।               (ক) তুমি হাঁটবে।
(খ) এবার (তুমি) একটি গান কর।      (খ) এবার একটি গান করা হোক ।
(গ) তার যেন আসা হয় ৷                  (গ) সে যেন আসে।


কর্মকর্তৃবাচ্য
যে বাক্যে কর্মপদই কর্তৃস্থানীয় হয়ে বাক্য গঠন করে, তাকে কর্মকর্তৃবাচ্যের বাক্য বলা হয়। যেমন—
কাজটা ভালো দেখায় না ।
বাঁশি বাজে এ মধুর লগনে ৷
সুতি কাপড় অনেক দিন টেকে।

Content added By

চতুর্থ পরিচ্ছেদ : উক্তি পরিবর্তন

কোনো কথকের বাক কর্মের নামই উক্তি। উক্তি দুই প্রকার : প্রত্যক্ষ উক্তি ও পরোক্ষ উক্তি।
যে বাক্যে বক্তার কথা অবিকল উদ্ধৃত হয়, তাকে প্রত্যক্ষ উক্তি বলে। যথা – তিনি বললেন, “বইটা আমার
দরকার।” যে বাক্যে বক্তার উক্তি অন্যের জবানিতে রূপান্তরিতভাবে প্রকাশিত হয়, তাকে পরোক্ষ উক্তি বলা হয়। যথা :
তিনি বললেন যে বইটা তাঁর দরকার।
উক্তি পরিবর্তনের নিয়ম
১. প্রত্যক্ষ উক্তিতে বক্তার বক্তব্যটুকু উদ্ধরণ চিহ্নের (“ ”) অন্তর্ভুক্ত থাকে। পরোক্ষ উক্তিতে উদ্ধরণ চিহ্ন লোপ পায়। প্রথম উদ্ধরণ চিহ্ন স্থানে ‘যে’ এই সংযোজক অব্যয়টি ব্যবহার করতে হয়। বাক্যের সঙ্গতি রক্ষার জন্য উক্তিতে ব্যবহৃত বক্তার পুরুষের পরিবর্তন করতে হয়। যেমন- প্রত্যক্ষ উক্তি : খোকা বলল, “আমার বাবা বাড়ি নেই।”
পরোক্ষ উক্তি : খোকা বলল যে, তার বাবা বাড়ি ছিলেন না।
২. বাক্যের অর্থ-সঙ্গতি রক্ষার জন্য সর্বনামের পরিবর্তন করতে হয়। যেমন- প্রত্যক্ষ উক্তি : রশিদ বলল, “আমার ভাই আজই ঢাকা যাচ্ছেন।” পরোক্ষ উক্তি : রশিদ বলল যে, তার ভাই সেদিনই ঢাকা যাচ্ছিলেন।
৩. প্রত্যক্ষ উক্তির কালবাচক পদকে পরোক্ষ উক্তিতে অর্থ অনুসারী করতে হয়। যেমন-
প্রত্যক্ষ উক্তি : শিক্ষক বললেন, “কাল তোমাদের ছুটি থাকবে।”
পরোক্ষ উক্তি : শিক্ষক বললেন যে, পরদিন আমাদের ছুটি থাকবে।

৪. প্রত্যক্ষ উক্তির বাক্যের সর্বনাম এবং কালসূচক শব্দের পরোক্ষ উক্তিতে নিম্নলিখিত পরিবর্তন সংঘটিত হয় ।

৫।অর্থ সঙ্গতি রক্ষার জন্য পরোক্ষ উক্তিতে ক্রিয়াপদের পরিবর্তন হতে পারে। যেমন— প্রত্যক্ষ উক্তি রহমান বলল, “আমি এখনই আসছি'। পরোক্ষ উক্তি : রহমান বলল যে, সে তখনই যাচ্ছে।
ক) প্রত্যক্ষ উক্তি পরোক্ষ উক্তি : ছেলেটি লিখেছিল, “শহরে খুব গরম পড়েছে।”

                          পরোক্ষ উক্তি :  ছেলেটি লিখেছিল যে, শহরে খুব গরম পড়েছিল।
৬. আশ্রিত খন্ড বাক্যের ক্রিয়ার কাল পরোক্ষ উক্তিতে সব সময় মূল বাক্যাংশের ক্রিয়ার কালের উপর নির্ভর করে না ।

খ.     প্রত্যক্ষ উক্তি : করিম বলেছিল, “আমি বাজারে যাচ্ছি।”
         পরোক্ষ উক্তি : করিম বলেছিল যে, সে বাজারে যাচ্ছে।
গ)       প্রত্যক্ষ উক্তি:মনসুর বলল, “আমি ঢাকা যাব । ”
           পরোক্ষ উক্তি : মনসুর বলল যে, সে ঢাকা যাবে।
প্রত্যক্ষ উক্তিতে কোনো চিরন্তন সত্যের উদ্ধৃতি থাকলে পরোক্ষ উক্তিতে কালের কোনো পরিবর্তন হয় না। যেমন-
ক)      প্রত্যক্ষ উক্তি শিক্ষক বললেন, “পৃথিবী গোলাকার।”
          পরোক্ষ উক্তি : শিক্ষক বললেন যে, পৃথিবী গোলাকার।
খ)      প্রত্যক্ষ উক্তি বৈজ্ঞানিক বললেন, “চুম্বক লোহাকে আকর্ষণ করে।”
          পরোক্ষ উক্তি বৈজ্ঞানিক বললেন যে, চুম্বক লোহাকে আকর্ষণ করে।

প্রশ্নবোধক বাক্য
ক)    প্রত্যক্ষ উক্তি শিক্ষক বললেন, “তোমরা কি ছুটি চাও?”
       পরোক্ষ উক্তি : আমরা ছুটি চাই কি না, শিক্ষক তা জিজ্ঞাসা করলেন।
খ.   প্রত্যক্ষ উক্তি : বাবা বললেন, “কবে নাগাদ তোমাদের ফল বের হবে?”
     পরোক্ষ উক্তি :আমাদের ফল কবে নাগাদ বের হবে, বাবা তা জানতে চাইলেন ।


অনুজ্ঞাসূচক বাক্য
ক)     প্রত্যক্ষ উক্তি  : হামিদ বলল, “তোমরা আগামীকাল এসো।”

         পরোক্ষ উক্তি :  হামিদ তাদের পরদিন আসতে (বা যেতে) বলল।
খ.      প্রত্যক্ষ উক্তি : তিনি বললেন, “দয়া করে ভেতরে আসুন।”
          পরোক্ষ উক্তি : তিনি (আমাকে) ভেতরে যেতে অনুরোধ করলেন।
আবেগসূচক বাক্য
ক)      প্রত্যক্ষ উক্তি  : লোকটি বলল, “বাঃ। পাখিটি তো চমৎকার।”

         পরোক্ষ উক্তি :লোকটি আনন্দের সাথে বলল যে, পাখিটি চমৎকার । :
খ)       প্রত্যক্ষ উক্তি : ভিখারিনী বলল, “শীতে আমরা কতই না কষ্ট পাচ্ছি।”
        পরোক্ষ উক্তি : ভিখারিনী দুঃখের সাথে বলল যে, তারা শীতে বড়ই কষ্ট পাচ্ছে।

Content added By

পঞ্চম পরিচ্ছেদ : যতি বা ছেদ-চিহ্নের লিখন কৌশল

বাক্যের অর্থ সুস্পষ্টভাবে বোঝার জন্য বাক্যের মধ্যে বা বাক্যের সমাপ্তিতে কিংবা বাক্যে আবেগ (হর্ষ, বিষাদ), জিজ্ঞাসা ইত্যাদি প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে বাক্য গঠনে যেভাবে বিরতি দিতে হয় এবং লেখার সময় বাক্যের মধ্যে তা দেখানোর জন্য যেসব সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করা হয়, তা-ই যতি বা ছেদচিহ্ন ।
নিচে বিভিন্ন প্রকার যতিচিহ্নের নাম, আকৃতি এবং তাদের বিরতি কালের পরিমাণ নির্দেশিত হলো


যতি বা ছেদচিহ্নের ব্যবহার
১. কমা [পাদচ্ছেদ (,)
ক) বাক্য পাঠকালে সুস্পষ্টতা বা অর্থ-বিভাগ দেখানোর জন্য যেখানে স্বল্প বিরতির প্রয়োজন, সেখানে কমা ব্যবহৃত হয়। যেমন— সুখ চাও, সুখ পাবে পরিশ্রমে।

খ) পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত একাধিক বিশেষ্য বা বিশেষণ পদ একসঙ্গে বসলে শেষ পদটি ছাড়া বাকি সবগুলোর পরই কমা বসবে। যেমন— সুখ, দুঃখ, আশা, নৈরাশ্য একই মালিকার পুষ্প।
গ) সম্বোধনের পরে কমা বসাতে হয়। যেমন— রশিদ, এদিকে এসো ।
ঘ) জটিল বাক্যের অন্তর্গত প্রত্যেক খণ্ডবাক্যের পরে কমা বসবে। যেমন— কাল যে লোকটি এসেছিল, সে আমার পূর্বপরিচিত।
ঙ) উদ্ধরণ চিহ্নের পূর্বে (খণ্ডবাক্যের শেষে) কমা বসাতে হবে। যেমন— সাহেব বললেন, “ছুটি পাবেন না।”
চ) মাসের তারিখ লিখতে বার ও মাসের পর ‘কমা' বসবে। যেমন— ১৬ই পৌষ, বুধবার, ১৩৯৯ সন।
ছ) বাড়ি বা রাস্তার নম্বরের পরে কমা বসবে। যেমন— ৬৮, নবাবপুর রোড, ঢাকা-১০০০ ।
জ) নামের পরে ডিগ্রিসূচক পরিচয় সংযোজিত হলে সেগুলোর প্রত্যেকটির পরে কমা বসবে। যেমন - ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক, এম.এ. পি-এইচ-ডি।

২. সেমিকোলন (;)
কমা অপেক্ষা বেশি বিরতির প্রয়োজন হলে, সেমিকোলন বসে। যথা— সংসারের মায়াজালে আবদ্ধ আমরা; এ মায়ার বাঁধন কি সত্যিই দুশ্ছেদ্য?
৩. দাঁড়ি বা পূর্ণচ্ছেদ (।)
বাক্যের পরিসমাপ্তি বোঝাতে দাঁড়ি বা পূর্ণচ্ছেদ ব্যবহার করতে হয়। যথা— শীতকালে এ দেশে আবহাওয়া শুষ্ক থাকে।
৪. প্রশ্নবোধক চিহ্ন (?)
বাক্যে কোনোকিছু জিজ্ঞাসা করা হলে বাক্যের শেষে প্রশ্নবোধক চিহ্ন বসে। যেমন— তুমি এখন এলে? সে কি যাবে?
৫. বিস্ময় ও সম্বোধন চিহ্ন (!)
হৃদয়াবেগ প্রকাশ করতে হলে এ সম্বোধন পদের পরে (!) চিহ্নটি বসে। যেমন-
আহা! কী চমৎকার দৃশ্য ৷
জননী। আজ্ঞা দেহ মোরে যাই রণস্থলে।
কিন্তু আধুনিক নিয়মে সম্বোধন স্থলে কমা চিহ্নের ব্যবহার করা হয়।
৬. কোলন (:)
একটি অপূর্ণ বাক্যের পরে অন্য একটি বাক্যের অবতারণা করতে হলে কোলন ব্যবহৃত হয়। যেমন- সভায় সাব্যস্ত হলো : একমাস পরে নতুন সভাপতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

৭. ড্যাস চিহ্ন (—)
যৌগিক ও মিশ্র বাক্যে পৃথক ভাবাপন্ন দুই বা তার বেশি বাক্যের সমন্বয় বা সংযোগ বোঝাতে ড্যাস চিহ্ন ব্যবহৃত
হয়। যেমন- তোমরা দরিদ্রের উপকার কর- এতে তোমাদের সম্মান যাবে না-বাড়বে।
৮. কোলন ড্যাস (:-)
উদাহরণ বা দৃষ্টান্ত প্রয়োগ করতে হলে কোলন এবং ড্যাস চিহ্ন একসঙ্গে ব্যবহৃত হয়। যেমন-পদ পাঁচ প্রকার:- বিশেষ্য, বিশেষণ, সর্বনাম, অব্যয় ও ক্রিয়া
৯. হাইফেন বা সংযোগ চিহ্ন (-)
সমাসবদ্ধ পদের অংশগুলো বিচ্ছিন্ন করে দেখানোর জন্য হাইফেনের ব্যবহার হয়। যেমন— এ আমাদের শ্রদ্ধা-অভিনন্দন, আমাদের প্রীতি—উপহার ।
১০. ইলেক (') বা লোপ চিহ্ন
কোনো বর্ণ বিশেষের লোপ বোঝাতে বিলুপ্ত বর্ণের জন্য (') লোপচিহ্ন দেওয়া হয় । যেমন-
মাথার ‘পরে জ্বলছে রবি (‘পরে=ওপরে)
পাগড়ি বাঁধা যাচ্ছে কারা? (কা'রা=কাহারা)
১১. উদ্ধরণ চিহ্ন ("")
বক্তার প্রত্যক্ষ উক্তিকে এই চিহ্নের অন্তর্ভুক্ত করতে হয়। যথা-শিক্ষক বললেন, “গতকাল তুরস্কে ভয়ানক
ভূমিকম্প হয়েছে।”
১২. ব্র্যাকেট বা বন্ধনী চিহ্ন ( ), { }, [ ]
এই তিনটি চিহ্নই গণিতশাস্ত্রে ব্যবহৃত হয়। তবে প্রথম বন্ধনীটি বিশেষ ব্যাখ্যামূলক অর্থে সাহিত্যে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন – ত্রিপুরায় (বর্তমানে কুমিল্লা) তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ব্যাকরণিক চিহ্ন বিশেষভাবে ব্যাকরণে নিম্নলিখিত চিহ্নগুলো ব্যবহৃত হয় ।
(ক) ধাতু বোঝাতে (√) চিহ্ন : √স্থা =স্থা ধাতু।
(খ) পরবর্তী শব্দ থেকে উৎপন্ন বোঝাতে (<) চিহ্ন: জাঁদরেল < জেনারেল।
(গ) পূর্ববর্তী শব্দ থেকে উৎপন্ন বোঝাতে (>) চিহ্ন: গঙ্গা > গাও ৷
(ঘ) সমানবাচক বা সমস্তবাচক বোঝাতে সমান (-) চিহ্ন : নর ও নারী = নরনারী।

Content added By

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : বাক্যের শ্রেণিবিভাগ

স্বরভঙ্গি ও বাগ্‌ভঙ্গি
১. অ-নে-ক অ-নে-ক দিন আগে বাংলাদেশে বিজয় সিংহ নামে খুব সাহসী এক রাজপুত্র ছিলেন ।
২. প্রকৃতি কী সুন্দর সাজেই না সেজেছে!
৩. তাজ্জব ব্যাপার!
৪. দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহীতে?
৫. “আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে। '
৬. ‘দীর্ঘজীবী হও।'
৭. ‘সবারে বাস রে ভালো। ’
৮. উঠে বস ।
ওপরের প্রথম বাক্যটি বিবৃতিমূলক; দ্বিতীয় ও তৃতীয় বাক্য দুটি বিস্ময়সূচক; চতুর্থ বাক্যটি প্রশ্নসূচক; পঞ্চম বাক্যটি প্রার্থনামূলক; যষ্ঠ বাক্যটি আশীর্বাদবোধক; সপ্তম বাক্যটি অনুরোধমূলক; অষ্টম বাক্যটি আদেশসূচক।
হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, আবেগ-উচ্ছ্বাস, অনুরোধ-প্রার্থনা, আদেশ-মিনতি, শাসন-তিরস্কার কণ্ঠস্বরের নানা ভঙ্গিতে উচ্চারণের মধ্যে প্রকাশিত হয় ।
বিশেষ জোর দিয়ে কথা বলা, কণ্ঠস্বরের ওঠা-নামা, কাঁপন, টেনে টেনে শব্দ উচ্চারণ ইত্যাদির দ্বারা বাক্যের বিশেষ বিশেষ অর্থ ও ভাব প্রকাশ করা সম্ভব। বিভিন্ন ভঙ্গিতে কণ্ঠধ্বনি উচ্চারণের ফলে যে ধ্বনি-তরঙ্গ সৃষ্টি হয়, তা নানা প্রকার ভাব ও অর্থ সৃষ্টি করে। এই ধ্বনি-তরঙ্গ বা স্বরতরঙ্গকে স্বরভঙ্গি বলে। এই স্বরভঙ্গিই বাভঙ্গির ভিত্তি ।
স্বরভঙ্গির দ্বারা যে শব্দ ও বাক্য সৃষ্ট ও উচ্চারিত হয়, তাকে লিখিত আকারে এবং উচ্চারিত অবস্থায় বাগ্‌ভঙ্গি
বলা যেতে পারে।
বাক্য নিম্নলিখিত কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত হতে পারে।
১. বিবৃতিমূলক বাক্য (Assertive sentence ) : সাধারণভাবে হ্যাঁ বা না বাচক বাক্য। বিবৃতিমূলক বাক্য দুই প্রকার হতে পারে : হ্যাঁ বাচক বাক্য (Affirmative sentence) এবং না বাচক বাক্য (Negative sentence)।
উদাহরণ-হ্যাঁ বাচক বাক্য : সে ঢাকা যাবে। আমি বলতে চাই ।
না বাচক বাক্য : সে ঢাকা যাবে না। আমি বলতে চাই না ।

২. প্রশ্নসূচক বাক্য (Interrogative sentence) : এ ধরনের বাক্যে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয় । যথা :
কোথায় যাচ্ছ? কী পড়ছ? কেন এসেছ? যাবে নাকি ?
৩. বিস্ময়সূচক বাক্য (Exclamatory sentence) : যে বাক্যে আশ্চর্যজনক কিছু বোঝায় তাকে বিস্ময়সূচক
বাক্য বলে। যথা : তাজ্জব ব্যাপার! সমুদ্রের সে কী ভীষণ গর্জন, ঢেউগুলো পাহাড়ের চূড়ার মতো উঁচু— আমি তো ভয়ে মরি! হুররে, , আমরা জিতেছি।
৪. ইচ্ছাসূচক বাক্য (Optative sentence) : এ ধরনের বাক্যে শুভজনক প্রার্থনা, আশিস, আকাঙ্ক্ষা করা হয়। যথা :
তোমার মঙ্গল হোক। ঈশ্বর তোমাকে জয়ী করুন। পরীক্ষায় সফল হও। দীর্ঘজীবী হও।
৫. আদেশ বাচক বাক্য (Imperative sentence) : এ ধরনের বাক্যে আদেশ করা হয়। যথা :
শিক্ষক মহোদয় শ্রেণিকক্ষে এলে উঠে দাঁড়াবে। চুপটি করে বস। উঠে দাঁড়াও । দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যুদ্ধ কর।
স্বরভঙ্গি তথা বাভঙ্গির সাহায্যে ক্রোধ, আদর, আনন্দ, দুঃখ, বিরক্তি, বিস্ময়, লজ্জা, ঘৃণা প্রভৃতি বিভিন্ন
প্রকার অনুভূতি প্রকাশ করা যায়। যথা :

১. সাধারণ বিবৃতিতে     সে আজ যাবে ।
২. জিজ্ঞাসায়              সে আজ যাবে?
৩. বিস্ময় প্রকাশে        সে আজ যাবে!
৪. ক্রোধ প্রকাশে        আমি তোমাকে দেখে নেব।
৫. আদর বোঝাতে      বড্ড শুকিয়ে গেছিস রে।
৬. আনন্দ প্রকাশে      বেশ বেশ, খুব ভালো হয়েছে!
৭. দুঃখ প্রকাশে          আহা, গাছ থেকে পড়ে পা ভেঙেছে!
৮. বিরক্তি প্রকাশে       আঃ, ভালো লাগছে না, এখন এখান থেকে যাও তো।
৯. ভীতি প্রদর্শনে       যাবি কি না বল?
১০. লজ্জা প্রকাশে      ছিঃ ছিঃ, তার সঙ্গে পারলে না।
১১. ধিক্কার দিতে       ছিঃ, তোমার এই কাজ
১২. ঘৃণা প্রকাশে       তুমি এত নীচ।
১৩. অনুরোধ প্রকাশে  কাজটি করে দাও না ভাই ৷

 ১৪. প্ৰাৰ্থনা               ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন ।


ছেদ ও বিরতিসূচক চিহ্নগুলো বাভঙ্গির লিখিত আকার প্রকাশে সাহায্য করে। দাঁড়ি, কমা, প্রশ্নবোধক ও বিস্ময়সূচক চিহ্ন বাক্যের ভাব ও অর্থবোধের জন্য উপকারক।

Content added By

সপ্তম পরিচ্ছেদ : বাক্যে পদ-সংস্থাপনার ক্রম

বাক্যের অন্তর্ভুক্ত পদগুলো উপযুক্ত স্থানে বসানোই পদ সংস্থাপনার ক্রম। একে কেউ কেউ পদক্রম বলে থাকেন।
নিয়মাবলি
১. সাধারণ বাক্যের প্রথমে সম্প্রসারকসহ উদ্দেশ্য (বা কর্তা) এবং বাক্যের শেষে সম্প্রসারকসহ বিধেয় (বা
ক্রিয়াপদ) বসবে। যেমন –


মনোযোগী      ছাত্ররাই       রীতিমত     পড়াশোনা করে।
(সম্প্রসারক)  (কর্তৃপদ)    (সম্প্রসারক) (ক্রিয়াপদ)


কিন্তু বাক্যকে শক্তিশালী করার জন্য এর ব্যতিক্রমও হতে পারে। যেমন –
লোকটি ছিল অত্যন্ত চতুর ।

২. সম্বন্ধ পদ বিশেষ্যের পূর্বে বসবে । যেমন – “ ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে।”
অর্থ সঙ্গতি রক্ষার জন্য বা ছন্দের অনুরোধে সম্বন্ধ পদ পরেও বসতে পারে। যেমন –
“হে আদি জননী সিন্ধু, বসুন্ধরা সন্তান তোমার।”
৩. কারক-বিভক্তিযুক্ত পদ বা অসমাপিকা ক্রিয়াপদ বিশেষণের আগে বসে। যেমন লোকটি ব্যবহারে খুবই ভদ্র। রাজশাহীর আম খেতে চমৎকার ।
৪. বিধেয় বিশেষণ সর্বদাই বিশেষ্যের পরে বসে। যথা : লোকটি যে জ্ঞানী তাতে সন্দেহ নেই ।
৫. বাক্যের প্রথমে কর্তা, পরে কর্ম এবং শেষে ক্রিয়াপদ বসে। যেমন – আমি ‘শাহনামা' পড়েছি।
(ক) কবিতায় এর ব্যতিক্রম হতে পারে। যেমন ‘লহ নমস্কার, সুন্দর আমার। ’
(খ) বাক্যে জোর দিতে গেলেও নিয়মের ব্যতিক্রম হতে পারে। যেমন – জানি, তোমার মুরোদ কতটুকু।
৬. বহুপদময় বিশেষণ অবশ্যই বিশেষ্যের পূর্বে বসে। যেমন - তোমার দাঁত বের-করা হাসি দেখলে সবারই পিত্ত জ্বলে যায় ৷
বাক্যে ‘না ' বা ‘নে' অব্যয়ের ব্যবহার
(ক) সমাপিকা ক্রিয়ার পরে বসে । যথা – আমি যাব না । আমি ভাত খাই নে, রুটি খাই।
(খ) অসমাপিকা ক্রিয়ার পূর্বে বসে। যথা – না চাইতে দানের কোনো মর্যাদা নেই ।

(গ) বিশেষণীয় বিশেষণ রূপে বিশেষণের পূর্বে বসে । যেমন না ভালো, না মন্দ।
(ঘ) ‘যদি’ দিয়ে বাক্য আরম্ভ করলে ‘না’ সমাপিকা ক্রিয়ার পূর্বে বসে । মেযন : তুমি যদি আজ না যাও, তা
হলে খুবই ক্ষতি হবে।
‘না' (নঞ ব্যতীত) অন্য অর্থে
ক. বিকল্পার্থে : জিজ্ঞাসাবাচক বাক্যে – তুমি বাড়ি যাবে, না আমি যাব ? : খ. অনুরোধ বা আদেশ অর্থে (নিরর্থকভাবে বাক্যের শেষে) : একটা গান গাও না ভাই ৷

Content added By

আরও দেখুন...

Promotion